ট্রাম্পের সঙ্গে ঝগড়ার পর কী হতে যাচ্ছে জেলেনস্কির ভাগ্যে?
বিশ্ব যেন এক নজিরবিহীর ‘ঝগড়া’ উপভোগ করল। সভ্যতার ইতিহাসে কোনো কূটনৈতিক বৈঠক এরকম পাড়া–মহল্লা বা সালিশ বৈঠকের ঝগড়ায় পরিণত হয়েছিল কি না, তা জানা নেই। গতকাল শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের ওভাল অফিসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সেই বিরল ঘটনাই ঘটল। এক সময় তাঁদের সঙ্গে বাগযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সও। সিএনএনের বিশ্লেষক নিক প্যাটন ওয়ালস এই ঘটনাকে ১৯৪৫ সালের পর ইউরোপের ইতিহাসে সবচেয়ে ‘গুরুত্বপূর্ণ মোড়’ বলে অভিহিত করেছেন।নিক প্যাটন কেন এই ঘটনাকে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ঘটনা বলছেন, চলুন একটু দেখা যাক: ট্রাম্প: আমাদের প্রতি আপনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। আমরা আপনাদের অনেক কিছু দিয়েছি।
জেলেনেস্কি: কৃতজ্ঞতা? যখন-তখন আমাদের মানুষদের মেরে ফেলা হচ্ছে। শহরগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর আপনি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে বলছেন? আপস করতে বলছেন তাদের সঙ্গে? ট্রাম্প: এ ছাড়া এই মুহূর্তে আপনার আর কিছু করার নেই।
জেলেনেস্কি: হ্যাঁ, কিছু করার নেই, কারণ আপনি সবকিছু আটকে রেখেছেন। আমাদের সহায়তা দিতে দেরি করছেন। পুতিনের মিথ্যা কথাগুলোরই পুনরাবৃত্তি করছেন আপনি। আর রাশিয়াকে সুযোগ করে দিচ্ছেন।
ভ্যান্স (আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট): ইউক্রেনকে অবশ্যই বাস্তববাদী হতে হবে।
জেলেনেস্কি আপনি কোন বাস্তববাদীতার কথা বলছেন? রাশিয়া অন্যায়ভাবে আমাদের জায়গা দখল করে নিচ্ছে, সাধারণ মানুষদের হত্যা করছে, শিশুদের পর্যন্ত অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। এত কিছুর পরেও আপনি বাস্তববাদী হতে বলেন?
ট্রাম্প: এভাবে চললে তো ব্যবসা চালানো কঠিন হয়ে পড়বে।
জেলেনেস্কি: এটা কোনো আবাসন প্রকল্পের চুক্তি নয়। আপনারা ওই পথে চললেও আমরা এভাবে চলতে পারি না।
ট্রাম্প: আমি আপনার জায়গায় থাকলে এই পরিস্থিতির–ই সৃষ্টি হতো না।
জেলেনেস্কি: হ্যা, আপনি ঠিকই বলেছে। আপনি ইউক্রেনকে ওদের হাতে তুলে দিতেন। এরপর ঝগড়া আরও তীব্র রূপ নেয়। ট্রাম্প রীতিমতো চিৎকার করতে থাকেন। জেলেনস্কিকে বলতে থাকেন, ‘আপনি আমেরিকাকে অসম্মান করছেন। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়া খেলছেন।’
এরপর কার্যত বৈঠক ভেস্তে যায়। মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, জেলেনস্কিকে ওভাল অফিস থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আর ইউরোপের সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, জেলেনস্কি বৈঠক শেষ না করেই বের হয়ে এসেছেন।
তবে উত্তপ্ত পরিস্থিতি ও জেলেনস্কির গোয়ার্তুমি দেখে ধারণা করা যায়, জেলেনস্কিকে বরে করেই দেওয়া হয়েছে।
বলে রাখা প্রয়োজন, গতকাল শুক্রবার ওভাল অফিসে ইউক্রেনের বিরল খনিজ নিয়ে চুক্তি করতে বসেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভলোদিমির জেলেনস্কি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দাবি, ইউক্রেন যুদ্ধে আমেরিকা এতদিন যত যহায়তা দিয়েছে, তার বিনিময়ে ইউক্রেনের বিরল খনিজগুলোর ৫০ শতাংশ আমেরিকাকে ইউক্রেনের দিয়ে দেওয়া উচিত। এসব খনিজ সংক্রান্ত চুক্তির বৈঠকেই বাকবিতণ্ডা হয়। এরপর ভেস্তে যায় বৈঠক। স্বাভাবিকভাবেই কোনো চুক্তিও হয়নি।
পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স হ্যান্ডলে জেলেনস্কি লেখেন—‘ধন্যবাদ আমেরিকা। ইউক্রেন ন্যায্য অধিকার ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পক্ষে। তার জন্য যা করণীয়, তা-ই করছে।’
অন্যদিকে ট্রাম্পও লিখেছেন, ‘ওভাল অফিসকে অপমান করেছেন জ়েলেনেস্কি। তবে শান্তির জন্য সত্যিই কখনো প্রস্তুত থাকলে তিনি আবার হোয়াইট হাউসে আসতে পারেন।’
এই ঘটনার পর জেলেনস্কির ভাগ্যে কী ঘটতে পারে, তা দেখার জন্যই এখন বিশ্ববাসীর অপেক্ষা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আমেরিকাকে ‘অসম্মান’ এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মুখে মুখে তর্ক করার জন্য জেলেনস্কিকে চরম মূল্য দিতে হবে। এরই মধ্যে জেলেনস্কিকে ‘স্বৈরশাসক’ বলে অভিহিত করেছেন ট্রাম্প। এর অর্থ হচ্ছে, রাজনৈতিকভাবেও চরম হেনস্থার মধ্যে পড়তে হবে জেলেনস্কিকে।
যদি তাই হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ও সামরিক সহায়তা ছাড়া জেলেনস্কির পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব—এটি অনস্বীকার্য। সে ক্ষেত্রে জেলেনস্কি যুদ্ধটা চালিয়ে যাবেন কী করে?
এই ঘটনা অথবা দুর্ঘটনার পর ইউরোপের দেশগুলো অবশ্য একাট্টা হয়েছে। জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শুলজ বলেন, ‘ইউক্রেনের মানুষ শান্তি চান। শান্তি কত জরুরি, তা ওঁদের চেয়ে বেশি কেউ জানেন না। সেই কারণেই আমরা সকলে দীর্ঘস্থায়ী শান্তির দাবি করে আসছি। জার্মানি এবং ইউরোপের উপর ভরসা রাখতে পারে ইউক্রেন।’
ফান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ বলেন, ‘আমরা তিন বছর আগেও ইউক্রেনকে সাহায্য করতে এবং রাশিয়ার ওপর বিধিনিষেধ চাপাতে সম্মত হয়েছিলাম। এখনও তা-ই করতে চাই। আমরা বলতে আমি আমেরিকা, সমগ্র ইউরোপ, জাপান, কানাডা— সকলের কথাই বলছি।’
ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লার্স লোক্কে রাসমুসেন বলেন, ‘ইউক্রেনের পেটে তো ঘুষি মারা হলো। বন্ধুদের মধ্যে আলোচনার রাস্তা খোলা রাখতে হবে। কিন্তু সেটা এভাবে প্রকাশ্যে ক্যামেরার সামনে হলে একজনই জিতে যান। আর তিনি ক্রেমলিনে বসে আছেন।’ ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভনডার লেইন বলেন, ‘ইউক্রেনের মানুষের সাহসকে সম্মান জানাই। কঠোর হোন, সাহসী হোন, ভয় পাবেন না। প্রেসিডেন্ট, আপনি একা নন। আমরা শান্তির জন্য আপনার পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই চালিয়ে যাব।’
এ ছাড়া মলদোভার প্রেসিডেন্ট মাইয়া স্যান্ডু, স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেড্রো স্যাঞ্চেস, নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ডিক স্কুফ, পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাক্স, চেক প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট পিটার প্যাভেলও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
এসব মিষ্টি মিষ্টি কথায় অবশ্য চিড়ে ভিজবে না। ইউক্রেনকে লড়াইটা শেষ পর্যন্ত লড়তে হবে অস্ত্র দিয়েই। আর সেই অস্ত্রের সবচেয়ে বড় জোগানদাতা যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র তথা ট্রাম্প যদি আর অস্ত্রের জোগান না দেন, তাহলে জেলেনস্কিকে এ যুদ্ধে অবশ্যই পরাজয় মেনে নিতে হবে। যদিও ইউক্রেনবাসীর কাছে জেলেনস্কি এখন ‘নায়কের মর্যাদা’ পাচ্ছেন, প্রচুর ‘বাহবা’ পাচ্ছেন, যেমন গতকাল একজন ইউক্রেনীয় মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে বলেছেন, ‘মর্যাদা একটি অত্যন্ত মূল্যবান বিষয়, রাশিয়া এত নৃশংসতা চালিয়েও আমাদের মর্যাদা ভাঙতে পারেনি, আমেরিকা কী করে আশা করে সেটি পারবে?’ তারপরও বলা যায়, শুধু আত্মমর্যাদার শক্তিতে বলিয়ান হয়ে একটি সশস্ত্র যুদ্ধ বছরের পর বছর ধরে চালানো যায় না।
জেলেনস্কি কি এই সত্য উপলব্ধি করতে পারছেন?
তথ্যসূত্র: সিএনএন, বিবিসি, রয়টার্স, এনবিসি নিউজ ও ফক্স নিউজ
Post a Comment